ঢাকা , সোমবার, ০৪ অগাস্ট ২০২৫, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে পড়া ঠিক নয়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না -প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ

বর্তমান বিশ্ব আজ বিজ্ঞানের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। নিমিষেই আমরা বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ভাব বিনিময়, আদান প্রদান করতে পারি। বিজ্ঞানের এ অবদানের পাশাপাশি নানা ধরনের অস্থিরতা, চঞ্চলতা ও সামাজিক প্রতিকূলতা তরুণ প্রজন্মকে সামনের দিকে এগোতে বাধাগ্রস্থ করছে। সামনের দিকে না এগিয়ে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেকটা দায়ী। এসব বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হই প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ এর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। বর্তমানে বিশ^দ্যিালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান। এখানে সমসাময়িক শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে যে আলাপচারিতা তা অগণিত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন: আপনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাই একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে কী ভাবছেন?   প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন : বর্তমান বিশ্ব আজ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। চারদিকে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা, সংঘাত। এই সংঘাতময় বিশ্বে টিকতে হলে শিক্ষা নিয়ে ভাবতেই হবে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন এতটা অস্থিরতা ছিল না। এই অস্থির সমাজে ছাত্র, যুবসমাজ নানাভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। আমাদের সময়ের চেয়ে আজকাল ছাত্ররাও অনেক মেধাবী। এ সব মেধাবী ছাত্ররা অস্থির সমাজের কারণে বিপথগামী হচ্ছে। তারা পথভ্রষ্ট হচ্ছে, সোজা পথ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তারা মাদকাসক্ত হয়ে সমাজের স্বাভাবিক পথ থেকে সরে যাচ্ছে। ফলে সমাজ হারাচ্ছে মেধাবী সন্তান যারা বড় হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনত। ছাত্র-ছাত্রীদের এই বয়সে ভাল মন্দ বিচার করে খারাপটা বর্জন করা এবং ভালটা গ্রহণ করার ক্ষমতা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখা দরকার সেভাবে প্রস্তুত রাখতেই হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ছাত্র-ছাত্রীরাই যে ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নয়, জাতি, দেশও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, চারদিকে যে অস্থিরতা তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্পর্শ করছে, কলেজ-স্কুলগুলোতে হানা দিচ্ছে। এজন্য আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বেশি সচেতন থাকতে হবে। অভিভাবদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে, শিক্ষকদের বেশি মনোযোগী থাকতে হবে। ক্লাসে শিক্ষা বিতরণ ছাড়াও কো-কারিকুলার কার্যক্রমেও শিক্ষকদের বেশি মনোযোগী হতে হবে। ছাত্ররা যদি শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি কো-কারিকুলার কার্যক্রমে অংশ নেয় তাহলে পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা থেকে দূরে থাকতে পারবে। সে জন্য সমাজের যেসমস্ত প্রতিকূলতা রয়েছে, যেখানে অস্থিরতা, অশান্তি বিরাজমান সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক কর্মকান্ডে বেশি করে জড়িত থাকতেই হবে। মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?   প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : আমরা বিভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছি। তবে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যাতে ভবিষ্যতে ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে পড়াশুনা করতে হবে। আমি আগেই বলেছি, বর্তমান বিশ্ব একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যে শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার সে শিক্ষাই গ্রহণ করতে হবে। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে আমরা যদি পিছিয়ে পড়ি তাহলে বিশ্বায়নের যুগে আমাদের মার খেতে হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : গ্রামীণ শিক্ষা সম্প্রসারণে সমাজপতিদের ভূমিকা ও করণীয় কি বলে আপনি মনে করেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : একটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেন দেশের প্রতিটি অঞ্চল অর্থাৎ গ্রাম হোক, শহর হোক যেন দেশের প্রতিটি অঞ্চলই শিক্ষিত হয়ে উঠে। কারণ সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা তখনই সম্ভব যখন গোটা দেশই শিক্ষিত হয়। গ্রামের লোককে অশিক্ষিত রেখে শহরের লোকেরা শিক্ষিত হবে বর্তমান যুগে এমনটি চিন্তা করা ঠিক নয়। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, ইদানিং গ্রাম-গঞ্জের অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে রয়েছে যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। তবে অনেক ছেলে-মেয়ে রয়েছে যারা সুযোগের অভাবে বিকশিত হতে পারছে না। এখন যদি তারা সুযোগ পায় তাহলে যথাযথভাবে বিকশিত হতে পারবে। আমরা যদি সমাজের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে যারা সুযোগের অভাবে ঝরে পড়ছে। পড়াশুনা করতে পারছে না। বঞ্চিত হচ্ছে নিজে এবং গোটা বিশ্বই। বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের যুগ। এই যুগে সম্ভাবনাকে যদি কাজে লাগানো না যায় তাহলে আমাদের পিছিয়েই পড়তে হবে। তাই আমরা, সমাজের যারা কর্ণধার, সমাজপতি তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড আর গ্রামীণ শিক্ষা সকল শিক্ষারই মেরুদন্ড। কারণ গ্রামীণ শিক্ষা যথাযথ না হলে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্র মসৃণ হবে না। তাই গ্রামীণ শিক্ষাকে মেরুদন্ড হিসেবে মানদন্ড মনে করে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই গ্রামের যারা মাতব্বর, সমাজপতি তাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটির পাশাপাশি শতাধিক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও রয়েছে। ফলে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটছে বলে অনেকেই মনে করেন- আপনি কী বলেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : দেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটি যে কনসেপ্টে কাজ করে তাহলো-একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। একে শক্তিশালী করার জন্য শিক্ষার ব্যয়ভার সরকারকে বহন করতে হবে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রে সরকারকে প্রায় ৯৫% ব্যয়ভার বহন করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারের পক্ষে এমনটি সম্ভব নয়। শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য আরো বেশি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। ব্যয়বহুল এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সরকারের পক্ষে খুবই দূরহ ব্যাপার। কারণ উচ্চ শিক্ষা মানেই অধিক ব্যয়ের বিষয়। আমরা জানি, সবকিছুর উর্ধে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনা। এক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানরা যেভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন সেজন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা উচিত বলে আমি মনে করি। এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারা জড়িত তাদের মনোভাব যেন কোনভাবেই ব্যবসাকেন্দ্রিক না হয়। মনে করতে হবে, তারা শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য কাজ করছেন। বিত্তবানদের এমন মনোভাব শিক্ষার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি। এর ফলে অভিভাবকদের আর্থিক কষ্ট লাঘব হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হচ্ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন-এবিষয়টি আপনি কীভাবে দেখবেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা সরকারের দেখা উচিত যেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত না হয়। সেখানে আয় ব্যয়ের নির্দিষ্ট হিসাব থাকবে, যে আয় হবে সেটা শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন ও অবকাঠামো সৃষ্টির ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার, লাইব্রেরী, কম্পিউটার ল্যাব যত উন্নত হবে ততই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ভাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় থেকে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : প্রায় সময়ই দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আপনি কি মনে করেন-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : একজন ছাত্রের মূল পরিচয় হলো- সে ছাত্র। তার প্রধান দায়িত্ব হলো পড়াশুনা করা। তবে আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, দেশের জন্য যখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই এগিয়ে এসেছে। শুধু এগিয়েই আসেনি, আমি বলল তারা দারুণভাবে এগিয়ে এসেছে। মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা সর্বাত্মক ভাবে এগিয়ে এসেছে। দেশের প্রয়োজনে তারা সবসময় নিঃস্বার্থভাবে ভূমিকা পালন করেছে। দেশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবদান তা বিশ্বের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আছে বলে আমার মনে হয় না। একারণে আমি বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেই করা যায়। কিন্তু একজন ছাত্র কোন রাজনৈতিক দল দ্বারা সার্বক্ষণিক পরিচালিত হবে বা তাদেরই জন্য কাজ করবে তেমনটা না হয়ে যদি কোন ছাত্র দেশের প্রয়োজনে কাজ করে সেটাই কাম্য। অর্থাৎ ছাত্ররা পড়াশুনার পাশাপাশি দেশের যখন প্রয়োজন হবে তখন যথাযথভাবে এগিয়ে আসবে। কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে সেটা কাম্য নয়। এবিষয়টি এখন সময়ের প্রয়োজনে আমাদের ভাবতে হবে। এবিষয়ে সরকার, বিরোধীদল ও সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে যে, ছাত্র রাজনীতিকে আমরা কেমনভাবে দেখব, কেমন হওয়া প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। মনে করলাম যে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেব, আর তা বন্ধ হবে-এমনটি হওয়ার কোন সুযোগ নেই।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : অনেকেই অভিযোগ করেন যে, শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িত হওয়া উচিত নয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে আপনি কী মনে করেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : এক্ষেত্রেও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা বলবো। দেশের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ছাত্ররা যেমন ভূমিকা রেখেছে তেমনি শিক্ষকরাও ভূমিকা রেখেছেন। শিক্ষকরা ছাত্রদের সঙ্গে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বও দিয়েছেন। আর শিক্ষকরা হচ্ছেন একটা দেশের সিনিয়র নাগরিক। তারা সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং বিবেকবান ব্যক্তিত্ব। তারা তাদের বিবেক নিয়ে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে তাদেরকে দিকনির্দশনা দেওয়ার সুযোগ নেই। তারা রাজনীতি করতে পারবে না এমনটি ভাবারও প্রয়োজন নাই। তবে শিক্ষকরা ছাত্রদের ক্লাসে পাঠদান করাবেন, গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, ছাত্রদের কো-কারিকুলার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রাখবেন-এসব কার্যক্রমে বরাবরই শিক্ষকরা অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন। তারপরও বিভিন্ন কমিউনিটি থেকে শিক্ষকদের ভুল বুঝা হয়। আমি মনে করি এধরনের ভুল বুঝা ঠিক নয়। তারা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সে ভাবেই করতে দেওয়া উচিত। সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়ে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নিবেন শিক্ষকরা সেখানে সম্পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবেন। রাজনৈতিক কোন বিষয়ে শিক্ষকরা অত্যন্ত সচেতন, তাঁদের অবদান অপরিসীম।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : সমাবর্তন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং শিক্ষা শেষে ছাত্রদের সনদ পাওয়ার আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। কিন্তু দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হিসেবে বলবেন কী-সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : সমাবর্তনের ক্ষেত্রে এধরনের অভিযোগ বর্তমান সময়ে ঠিক নয়। আমি যখন উপাচার্য ছিলাম তখন চারবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। কিছুদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবিষয়টা প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ইদানিং কালে চলে আসছে। তবে আগের কথা বললে বলবো- প্রায় কেউই সমাবর্তনের মাধ্যমে সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে পারেননি। এখন সমাবর্তন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শুধুমাত্র কোন প্রতিকূলতা সৃষ্টি না হলেই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে। তাই এবিষয়টি নিয়ে এখন আর দুর্ভাবনার কোন কারণ নেই।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এবিষয়ে আপনি কী বলবেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে তারিখও ঘোষণা করেছে, কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা বড় কোন বিষয় নয়। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য নির্বাচন দেওয়া খুবই সহজ একটা বিষয়।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাই মুখ্য-এবিষয়ে আপনার মতামত বলবেন কী? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : হ্যাঁ, শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা মুখ্য সেটা যেমন ঠিক তেমনি বলতে হয় একজন শিক্ষকের যে ধরনের মর্যাদা পাওয়া দরকার সে ধরনের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা আমরা কি দিচ্ছি! একজন ব্যক্তি যখন শিক্ষকতা পেশায় আসেন তখন তাকে মেধাবী হতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। কিন্তু তাকে যে বেতন দেওয়া হয় তা দিয়ে তিনি চলতে পারেন? বেতনের টাকা দিয়ে তিনি কি বাসা ভাড়া দিতে পারেন? কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল করা হয়েছে। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের চেয়ে শিক্ষকদের তিন-চারগুণ বেশি বেতন দেওয়া হয় এমন দেশের সংখ্যা অনেক রয়েছে। আমাদের দেশেও যদি ঐসব দেশের শিক্ষকদের মত আলাদা বেতন কাঠামো ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ধরনের অবদান রাখা দরকার তা তাঁরা রাখতে পারবেন। শিক্ষার মানও উন্নত হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : ছাত্র-তরুণদের অনেকেই আজ বিপথগামী-এর কারণ কী আপনি মনে করনে? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : চারদিকে রয়েছে নানা ধরনের অস্থিরতা, চঞ্চলতা, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিকূলতা। এসব প্রতিকূলতা একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে আক্রমণ করলে বয়সের কারণে সে দূরে সরে আসতে পারে। কিন্তু তারুণ্যের ক্ষেত্রে সবসময় সম্ভব হয় না। বর্তমানে সামাজিক প্রতিকূলতার কারণে ছাত্র-তরুণদের অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে মসৃণ পথ থেকে। তাই আমাদের সময় আমরা যতটা সচেতন ছিলাম তারচেয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বেশি সচেতন হতে হবে। বর্তমান ছাত্ররা অত্যন্ত মেধাবী। মেধাকে কাজে লাগাতে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে দেশ, গোটা জাতি, বিশ্ব। তাদের মেধার জোরেই আগামী বিশ্ব আরও ভাল কিছু প্রত্যাশা করে। সকলের প্রত্যাশা মূল্যায়ন করতে অবশ্যই বর্তমান ছাত্র-তরুণদের সচেতন থেকেই এগিয়ে যেতে হবে।   অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ইউজিসির চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ফায়েজের মেয়াদ হবে ৪ বছর, প্রচলিত বিধি অনুযায়ী বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধা পাবেন তিনি। এই নিয়োগ তার যোগদানের তারিখ থেকে কার্যকর হবে। তিনি একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক এবং বিজ্ঞানী, যিনি মৃত্তিকা বিজ্ঞান, পরিবেশগত অধ্যয়ন এবং শিক্ষানীতিতে অবদানের জন্য পরিচিত। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬তম উপাচার্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের ষষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাথমিক জীবন : সৈয়দ মুহাম্মদ আবুল ফায়েজ ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ২৪ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকায় বেড়ে ওঠেন তিনি। তার বাবা এ কে কেবি সৈয়দ মুহাম্মদ হাসান আলী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন জোবেদা খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে ব্যাচেলর এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে গবেষণার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্য যান এবং এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ থেকে “মাটি: উদ্ভিদ ও পানির মধ্যকার সম্পর্ক” বিষয়ে মাত্র দুই বছরেরও সামান্য বেশি সময়ের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা জার্নালে তাঁর শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কর্মজীবন : সৈয়দ মুহাম্মদ আবুল ফায়েজ ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল নাগাদ তিনি নাইজেরিয়াস্থ মাইদুগড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে কাজ করেন। প্রফেসর ফায়েজ ছিলেন বাংলাদেশের সরকারি চাকুরীর জন্য নিয়োগ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন’-এর ষষ্ঠ চেয়ারম্যান; ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের অবসর গ্রহণের পর ১৯৯৩ সালের ৭ মার্চ তারিখে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন এবং ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। জনাব এসএমএ ফায়েজ ২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঠামোগত ও পাঠ্যক্রমিক সংস্কারের সূচনা করেন। তিনি ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পূর্বে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি কয়েক বছর হাজী মোঃ মহসীন হলের প্রভোস্ট ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন তিনি। ৫ বছরেরও বেশি সময় তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ৬ বছরেরও বেশি সময় ফাউন্ডেশন ফর রিসার্চ অন এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এফইপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সালে তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। গবেষণা এবং প্রকাশনা: উচ্চশিক্ষা খাত নিয়ে তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। তিনি ১০০ টিরও বেশি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন এবং বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক।   পাদটীকা : প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ-এর সাক্ষাৎকারটি সাপ্তাহিক সময়ের কণ্ঠস্বর পত্রিকায় ২০১০ সালে ৪র্থ বর্ষের মার্চ (২২-৩১), ৩৭তম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সেই সময়ের সাক্ষাৎকারটির মূল্যবান বক্তব্যগুলো যেন চিরন্তন বাণী। তাই হুবহু পুনঃমুদ্রিত হলো। -নির্বাহী সম্পাদক।

ট্যাগস

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে পড়া ঠিক নয়

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না -প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ

আপডেট সময় ১৬ ঘন্টা আগে
বর্তমান বিশ্ব আজ বিজ্ঞানের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। নিমিষেই আমরা বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ভাব বিনিময়, আদান প্রদান করতে পারি। বিজ্ঞানের এ অবদানের পাশাপাশি নানা ধরনের অস্থিরতা, চঞ্চলতা ও সামাজিক প্রতিকূলতা তরুণ প্রজন্মকে সামনের দিকে এগোতে বাধাগ্রস্থ করছে। সামনের দিকে না এগিয়ে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেকটা দায়ী। এসব বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হই প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ এর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। বর্তমানে বিশ^দ্যিালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান। এখানে সমসাময়িক শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে যে আলাপচারিতা তা অগণিত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন: আপনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাই একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গন নিয়ে কী ভাবছেন?   প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন : বর্তমান বিশ্ব আজ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। চারদিকে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা, সংঘাত। এই সংঘাতময় বিশ্বে টিকতে হলে শিক্ষা নিয়ে ভাবতেই হবে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন এতটা অস্থিরতা ছিল না। এই অস্থির সমাজে ছাত্র, যুবসমাজ নানাভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। আমাদের সময়ের চেয়ে আজকাল ছাত্ররাও অনেক মেধাবী। এ সব মেধাবী ছাত্ররা অস্থির সমাজের কারণে বিপথগামী হচ্ছে। তারা পথভ্রষ্ট হচ্ছে, সোজা পথ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তারা মাদকাসক্ত হয়ে সমাজের স্বাভাবিক পথ থেকে সরে যাচ্ছে। ফলে সমাজ হারাচ্ছে মেধাবী সন্তান যারা বড় হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনত। ছাত্র-ছাত্রীদের এই বয়সে ভাল মন্দ বিচার করে খারাপটা বর্জন করা এবং ভালটা গ্রহণ করার ক্ষমতা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখা দরকার সেভাবে প্রস্তুত রাখতেই হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ছাত্র-ছাত্রীরাই যে ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নয়, জাতি, দেশও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, চারদিকে যে অস্থিরতা তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্পর্শ করছে, কলেজ-স্কুলগুলোতে হানা দিচ্ছে। এজন্য আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বেশি সচেতন থাকতে হবে। অভিভাবদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে, শিক্ষকদের বেশি মনোযোগী থাকতে হবে। ক্লাসে শিক্ষা বিতরণ ছাড়াও কো-কারিকুলার কার্যক্রমেও শিক্ষকদের বেশি মনোযোগী হতে হবে। ছাত্ররা যদি শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি কো-কারিকুলার কার্যক্রমে অংশ নেয় তাহলে পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা থেকে দূরে থাকতে পারবে। সে জন্য সমাজের যেসমস্ত প্রতিকূলতা রয়েছে, যেখানে অস্থিরতা, অশান্তি বিরাজমান সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক কর্মকান্ডে বেশি করে জড়িত থাকতেই হবে। মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?   প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : আমরা বিভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছি। তবে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যাতে ভবিষ্যতে ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে পড়াশুনা করতে হবে। আমি আগেই বলেছি, বর্তমান বিশ্ব একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যে শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার সে শিক্ষাই গ্রহণ করতে হবে। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে আমরা যদি পিছিয়ে পড়ি তাহলে বিশ্বায়নের যুগে আমাদের মার খেতে হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : গ্রামীণ শিক্ষা সম্প্রসারণে সমাজপতিদের ভূমিকা ও করণীয় কি বলে আপনি মনে করেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : একটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেন দেশের প্রতিটি অঞ্চল অর্থাৎ গ্রাম হোক, শহর হোক যেন দেশের প্রতিটি অঞ্চলই শিক্ষিত হয়ে উঠে। কারণ সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা তখনই সম্ভব যখন গোটা দেশই শিক্ষিত হয়। গ্রামের লোককে অশিক্ষিত রেখে শহরের লোকেরা শিক্ষিত হবে বর্তমান যুগে এমনটি চিন্তা করা ঠিক নয়। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, ইদানিং গ্রাম-গঞ্জের অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে রয়েছে যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। তবে অনেক ছেলে-মেয়ে রয়েছে যারা সুযোগের অভাবে বিকশিত হতে পারছে না। এখন যদি তারা সুযোগ পায় তাহলে যথাযথভাবে বিকশিত হতে পারবে। আমরা যদি সমাজের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে যারা সুযোগের অভাবে ঝরে পড়ছে। পড়াশুনা করতে পারছে না। বঞ্চিত হচ্ছে নিজে এবং গোটা বিশ্বই। বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের যুগ। এই যুগে সম্ভাবনাকে যদি কাজে লাগানো না যায় তাহলে আমাদের পিছিয়েই পড়তে হবে। তাই আমরা, সমাজের যারা কর্ণধার, সমাজপতি তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড আর গ্রামীণ শিক্ষা সকল শিক্ষারই মেরুদন্ড। কারণ গ্রামীণ শিক্ষা যথাযথ না হলে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্র মসৃণ হবে না। তাই গ্রামীণ শিক্ষাকে মেরুদন্ড হিসেবে মানদন্ড মনে করে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই গ্রামের যারা মাতব্বর, সমাজপতি তাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটির পাশাপাশি শতাধিক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও রয়েছে। ফলে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটছে বলে অনেকেই মনে করেন- আপনি কী বলেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : দেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটি যে কনসেপ্টে কাজ করে তাহলো-একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। একে শক্তিশালী করার জন্য শিক্ষার ব্যয়ভার সরকারকে বহন করতে হবে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রে সরকারকে প্রায় ৯৫% ব্যয়ভার বহন করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারের পক্ষে এমনটি সম্ভব নয়। শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য আরো বেশি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। ব্যয়বহুল এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সরকারের পক্ষে খুবই দূরহ ব্যাপার। কারণ উচ্চ শিক্ষা মানেই অধিক ব্যয়ের বিষয়। আমরা জানি, সবকিছুর উর্ধে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনা। এক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানরা যেভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন সেজন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা উচিত বলে আমি মনে করি। এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারা জড়িত তাদের মনোভাব যেন কোনভাবেই ব্যবসাকেন্দ্রিক না হয়। মনে করতে হবে, তারা শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য কাজ করছেন। বিত্তবানদের এমন মনোভাব শিক্ষার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি। এর ফলে অভিভাবকদের আর্থিক কষ্ট লাঘব হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হচ্ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন-এবিষয়টি আপনি কীভাবে দেখবেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা সরকারের দেখা উচিত যেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত না হয়। সেখানে আয় ব্যয়ের নির্দিষ্ট হিসাব থাকবে, যে আয় হবে সেটা শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন ও অবকাঠামো সৃষ্টির ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার, লাইব্রেরী, কম্পিউটার ল্যাব যত উন্নত হবে ততই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ভাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় থেকে এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : প্রায় সময়ই দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আপনি কি মনে করেন-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : একজন ছাত্রের মূল পরিচয় হলো- সে ছাত্র। তার প্রধান দায়িত্ব হলো পড়াশুনা করা। তবে আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, দেশের জন্য যখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই এগিয়ে এসেছে। শুধু এগিয়েই আসেনি, আমি বলল তারা দারুণভাবে এগিয়ে এসেছে। মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা সর্বাত্মক ভাবে এগিয়ে এসেছে। দেশের প্রয়োজনে তারা সবসময় নিঃস্বার্থভাবে ভূমিকা পালন করেছে। দেশের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবদান তা বিশ্বের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আছে বলে আমার মনে হয় না। একারণে আমি বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেই করা যায়। কিন্তু একজন ছাত্র কোন রাজনৈতিক দল দ্বারা সার্বক্ষণিক পরিচালিত হবে বা তাদেরই জন্য কাজ করবে তেমনটা না হয়ে যদি কোন ছাত্র দেশের প্রয়োজনে কাজ করে সেটাই কাম্য। অর্থাৎ ছাত্ররা পড়াশুনার পাশাপাশি দেশের যখন প্রয়োজন হবে তখন যথাযথভাবে এগিয়ে আসবে। কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে সেটা কাম্য নয়। এবিষয়টি এখন সময়ের প্রয়োজনে আমাদের ভাবতে হবে। এবিষয়ে সরকার, বিরোধীদল ও সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে যে, ছাত্র রাজনীতিকে আমরা কেমনভাবে দেখব, কেমন হওয়া প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। মনে করলাম যে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেব, আর তা বন্ধ হবে-এমনটি হওয়ার কোন সুযোগ নেই।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : অনেকেই অভিযোগ করেন যে, শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িত হওয়া উচিত নয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে আপনি কী মনে করেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : এক্ষেত্রেও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা বলবো। দেশের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ছাত্ররা যেমন ভূমিকা রেখেছে তেমনি শিক্ষকরাও ভূমিকা রেখেছেন। শিক্ষকরা ছাত্রদের সঙ্গে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বও দিয়েছেন। আর শিক্ষকরা হচ্ছেন একটা দেশের সিনিয়র নাগরিক। তারা সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং বিবেকবান ব্যক্তিত্ব। তারা তাদের বিবেক নিয়ে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে তাদেরকে দিকনির্দশনা দেওয়ার সুযোগ নেই। তারা রাজনীতি করতে পারবে না এমনটি ভাবারও প্রয়োজন নাই। তবে শিক্ষকরা ছাত্রদের ক্লাসে পাঠদান করাবেন, গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, ছাত্রদের কো-কারিকুলার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রাখবেন-এসব কার্যক্রমে বরাবরই শিক্ষকরা অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন। তারপরও বিভিন্ন কমিউনিটি থেকে শিক্ষকদের ভুল বুঝা হয়। আমি মনে করি এধরনের ভুল বুঝা ঠিক নয়। তারা যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সে ভাবেই করতে দেওয়া উচিত। সকল রাজনৈতিক দল একমত হয়ে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নিবেন শিক্ষকরা সেখানে সম্পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবেন। রাজনৈতিক কোন বিষয়ে শিক্ষকরা অত্যন্ত সচেতন, তাঁদের অবদান অপরিসীম।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : সমাবর্তন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং শিক্ষা শেষে ছাত্রদের সনদ পাওয়ার আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। কিন্তু দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হিসেবে বলবেন কী-সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : সমাবর্তনের ক্ষেত্রে এধরনের অভিযোগ বর্তমান সময়ে ঠিক নয়। আমি যখন উপাচার্য ছিলাম তখন চারবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। কিছুদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবিষয়টা প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ইদানিং কালে চলে আসছে। তবে আগের কথা বললে বলবো- প্রায় কেউই সমাবর্তনের মাধ্যমে সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে পারেননি। এখন সমাবর্তন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শুধুমাত্র কোন প্রতিকূলতা সৃষ্টি না হলেই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে। তাই এবিষয়টি নিয়ে এখন আর দুর্ভাবনার কোন কারণ নেই।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এবিষয়ে আপনি কী বলবেন? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে তারিখও ঘোষণা করেছে, কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা বড় কোন বিষয় নয়। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য নির্বাচন দেওয়া খুবই সহজ একটা বিষয়।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাই মুখ্য-এবিষয়ে আপনার মতামত বলবেন কী? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : হ্যাঁ, শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা মুখ্য সেটা যেমন ঠিক তেমনি বলতে হয় একজন শিক্ষকের যে ধরনের মর্যাদা পাওয়া দরকার সে ধরনের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা আমরা কি দিচ্ছি! একজন ব্যক্তি যখন শিক্ষকতা পেশায় আসেন তখন তাকে মেধাবী হতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। কিন্তু তাকে যে বেতন দেওয়া হয় তা দিয়ে তিনি চলতে পারেন? বেতনের টাকা দিয়ে তিনি কি বাসা ভাড়া দিতে পারেন? কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল করা হয়েছে। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের চেয়ে শিক্ষকদের তিন-চারগুণ বেশি বেতন দেওয়া হয় এমন দেশের সংখ্যা অনেক রয়েছে। আমাদের দেশেও যদি ঐসব দেশের শিক্ষকদের মত আলাদা বেতন কাঠামো ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ধরনের অবদান রাখা দরকার তা তাঁরা রাখতে পারবেন। শিক্ষার মানও উন্নত হবে।   মুহাম্মাদ তছলিম উদ্দিন : ছাত্র-তরুণদের অনেকেই আজ বিপথগামী-এর কারণ কী আপনি মনে করনে? প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ : চারদিকে রয়েছে নানা ধরনের অস্থিরতা, চঞ্চলতা, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিকূলতা। এসব প্রতিকূলতা একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে আক্রমণ করলে বয়সের কারণে সে দূরে সরে আসতে পারে। কিন্তু তারুণ্যের ক্ষেত্রে সবসময় সম্ভব হয় না। বর্তমানে সামাজিক প্রতিকূলতার কারণে ছাত্র-তরুণদের অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে মসৃণ পথ থেকে। তাই আমাদের সময় আমরা যতটা সচেতন ছিলাম তারচেয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বেশি সচেতন হতে হবে। বর্তমান ছাত্ররা অত্যন্ত মেধাবী। মেধাকে কাজে লাগাতে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে দেশ, গোটা জাতি, বিশ্ব। তাদের মেধার জোরেই আগামী বিশ্ব আরও ভাল কিছু প্রত্যাশা করে। সকলের প্রত্যাশা মূল্যায়ন করতে অবশ্যই বর্তমান ছাত্র-তরুণদের সচেতন থেকেই এগিয়ে যেতে হবে।   অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ইউজিসির চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ফায়েজের মেয়াদ হবে ৪ বছর, প্রচলিত বিধি অনুযায়ী বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধা পাবেন তিনি। এই নিয়োগ তার যোগদানের তারিখ থেকে কার্যকর হবে। তিনি একজন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক এবং বিজ্ঞানী, যিনি মৃত্তিকা বিজ্ঞান, পরিবেশগত অধ্যয়ন এবং শিক্ষানীতিতে অবদানের জন্য পরিচিত। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬তম উপাচার্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের ষষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাথমিক জীবন : সৈয়দ মুহাম্মদ আবুল ফায়েজ ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ২৪ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকায় বেড়ে ওঠেন তিনি। তার বাবা এ কে কেবি সৈয়দ মুহাম্মদ হাসান আলী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার মা ছিলেন জোবেদা খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে ব্যাচেলর এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে গবেষণার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্য যান এবং এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ থেকে “মাটি: উদ্ভিদ ও পানির মধ্যকার সম্পর্ক” বিষয়ে মাত্র দুই বছরেরও সামান্য বেশি সময়ের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা জার্নালে তাঁর শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কর্মজীবন : সৈয়দ মুহাম্মদ আবুল ফায়েজ ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল নাগাদ তিনি নাইজেরিয়াস্থ মাইদুগড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে কাজ করেন। প্রফেসর ফায়েজ ছিলেন বাংলাদেশের সরকারি চাকুরীর জন্য নিয়োগ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন’-এর ষষ্ঠ চেয়ারম্যান; ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের অবসর গ্রহণের পর ১৯৯৩ সালের ৭ মার্চ তারিখে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন এবং ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। জনাব এসএমএ ফায়েজ ২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঠামোগত ও পাঠ্যক্রমিক সংস্কারের সূচনা করেন। তিনি ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পূর্বে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি কয়েক বছর হাজী মোঃ মহসীন হলের প্রভোস্ট ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন তিনি। ৫ বছরেরও বেশি সময় তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ৬ বছরেরও বেশি সময় ফাউন্ডেশন ফর রিসার্চ অন এডুকেশনাল প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এফইপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সালে তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। গবেষণা এবং প্রকাশনা: উচ্চশিক্ষা খাত নিয়ে তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। তিনি ১০০ টিরও বেশি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন এবং বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক।   পাদটীকা : প্রফেসর এসএমএ ফায়েজ-এর সাক্ষাৎকারটি সাপ্তাহিক সময়ের কণ্ঠস্বর পত্রিকায় ২০১০ সালে ৪র্থ বর্ষের মার্চ (২২-৩১), ৩৭তম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সেই সময়ের সাক্ষাৎকারটির মূল্যবান বক্তব্যগুলো যেন চিরন্তন বাণী। তাই হুবহু পুনঃমুদ্রিত হলো। -নির্বাহী সম্পাদক।